কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য (১৯২৬-১৯৪৭)

কিশোর কবি সুকান্ত ও তাঁর কবিতায় আকালের চিত্র

রচনা:- কিশোর মজুমদার

Sukanta Bhattacharya, কিশোর কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য, বাংলা কাব্যসাহিত্যে সুকান্ত ভট্টাচার্যের অবদান , কবি সুকান্ত, ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময় … , সুকান্ত ভট্টাচার্যের বিখ্যাত উক্তি, এগুলি সম্পর্কিত বিস্তারিত বিষয় এই রচনায় গ্রন্থিবদ্ধ করা হয়েছে ।


কবি সুকান্ত ও তাঁর কবিতায় আকাল

বাংলা কাব্য সাহিত্যের জগতে সুকান্ত ভট্টাচার্য (১৯২৬-১৯৪৬) এক অতি পরিচিত এবং জনপ্রিয় নাম । সবার প্রিয় এই ‘কিশাের কবি’ শােষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার আদর্শে উদ্বুদ্ধ সংগ্রামী মানুষের প্রেরণা ছিলেন । তাঁর প্রতিভার চমক আর কবিতার বিপুল আবেদন জীবৎকালেই তাকে বেশ জনপ্রিয় করেছিল । স্বাধীনতার স্বপ্নে বিভাের এই কবি দেশ স্বাধীন হবার মাত্র তিন মাস আগে ১৯৪৭ সালের ১২ই মে পার্থিব মায়া ত্যাগ করে চলে যান বড় অসময়ে। সুকান্তর এই মৃত্যুটাই যেন বাঙালির কাছে একটা বেদনাবিধুর কবিতা।
সুকান্তর শৈশব ও কৈশাের কেটেছিল দেশের উত্তাল আবহাওয়া ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহ ব্যাপ্তির মধ্যে। যেখানে ছিল মন্বন্তর, ফ্যাসিস্ট-বিরােধী আন্দোলন, স্বাধীনতা সংগ্রাম, শ্রমিক ধর্মঘট আর ভ্রাতৃঘাতী সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। ১৯৪০ থেকে ১৯৪৭ এইভয়াবহ উত্তাল সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতিতেই সুকান্তর কাব্যচর্চা। ফলে তাঁর রচনায় আমরা খুঁজে পাই সমকালীন সামাজিক, রাজনৈতিক পরিবেশ পরিস্থিতির কাব্যরূপায়ণ। আর এখানেই তিনি সমযুগে স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখেছেন। রবীন্দ্রনাথ শেষ বয়সে এমন একজন কবিকে আহ্বান করে গিয়েছিলেন, যিনি গাইবেন মাটির কাছের নিপীড়িত মানুষের জাগরণের গান, মাটির মর্মবাণী যিনি শােনাবেন বাংলা কাব্যের আকাশে বাতাসে। সে গান রবীন্দ্রনাথ গাইতে পারেন নি; তবে প্রত্যাশা করেছিলেন একজন গাইবেন। বলাকা’র পরে নবজাতক-এ তিনি আন্তরিক আহ্বান জানালেন নবীন আগন্তুককে –
নবীন আগন্তুক
নবযুগ তব যাত্রার পথে
চেয়ে আছে উৎসুক।

-কবির এই আহ্বানে সাড়া দিতেই যেন সুকান্ত এক নবজাতকের ছাড়পত্র নিয়ে আবির্ভূত হয়েছেন
“এসেছে নতুন শিশু , তাকে ছেড়ে দিতে হবে স্থান;
জীর্ণ পৃথিবীতে ব্যর্থ, মৃত আর ধংসস্তুপ – পিঠে
চলে যেতে হবে আমাদের।” (ছাড়পত্র /নাম কবিতা)

শােষিত নিপীড়িত, বঞ্চিত ক্ষুধাতুর মানুষের মধ্যে সংগ্রামী চেতনা উজ্জীবিত করে এক বিপ্লবের স্পন্দন জাগিয়ে তোলাই ছিল সুকান্তর ‘দৃঢ় অঙ্গীকার’।
কোনাে ভাব কল্পনা বা আদর্শ আকাশ থেকে পড়ে না, জীবনের মধ্যেই তার সৃষ্টি – আর সেই জীবন সমাজবদ্ধ। তাই বলা যায় কোনাে ভাব বা আদর্শের মধ্যেই নিহিত আছে সৃষ্টিকালের সমাজ চেতনা। সামাজিক ইতিহাসের মধ্যেই সে যুগের সমাজ-চেতনার সন্ধান করতে হয়। কোনাে ঐতিহাসিক যুগের আর্থ সামাজিক কাঠামাে সেই যুগের রাজনৈতিকও মানসিক ইতিহাসের ভিত্তিভূমি। এক সময় ভূমির ওপর ছিল মানুষের যৌথ মালিকানা আর যেদিন থেকে যৌথ মালিকানা অবলুপ্ত হতে থাকে তখন থেকেই শুরু হয় শ্রেণি সংগ্রামের ইতিহাস। সমাজ বিকাশের বিভিন্ন স্তরে শুরু হয় অবদমিত ও প্রভূত্বকারী শ্রেণির তথা শােষক-শােষিতের সংগ্রামের ইতিহাস।
ভারত তথা বাংলাদেশে যখন বিদেশী শাসনশােষণ-অপশাসনে পীড়িত সাধারণ মানুষ, তখন সমাজের ভেতরের অবস্থাও ছিল সঙ্কটময়।
জমিদার, ধনীক শ্রেণি , বণিক শ্রেণি ও মহাজনদের হাতে নিষ্পেষিত হতে থাকে ক্রমশ শ্রমিক শ্রেণিতে পরিণত হতে থাকা কৃষক ও দরিদ্র মানুষ। এর সঙ্গে ঘৃতাহুতি দেয় বিভিন্ন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। এই অপশাসনের নিষ্ঠুর চিত্র দেখেই নজরুল গাইলেন সাম্যের গান। তাঁর কবিতায় তুলে ধরলেন কীভাবে বাবু শ্রেণির হাতে নির্যাতিত হয় নিম্নবিত্তের মানুষ:-

দেখিনু সেদিন রেলে কুলি ব’লে এক বাবুসাব তারে ঠেলে দিল নীচে ফেলে/চোখ ফেটে এল জল— এমনি করে কি জগৎ জুড়িয়া মার খাবে দুর্বল !

আরও পড়ুনঃ👉বাংলা কাব্যে কাজী নজরুল ইসলামের অবদান


ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের নির্মম শােষণের এক শোচনীয় পরিণাম ঘন ঘন দুর্ভিক্ষ। ছিয়াত্তরের মন্তরের মর্মন্তুদ চিত্র বঙ্কিমের ‘আনন্দমঠ’-এ চিত্রিত হয়েছে। কিন্তু তার চেয়েও ভয়াবহ ছিল তেরশাে পঞ্চাশের মন্বন্তর। যার পেছনে প্রত্যক্ষ ও পরােক্ষ কারণ ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। – পঞ্চাশের মন্বন্তরের জীবন্ত আলেখ্য ফুটে উঠেছে বিভিন্ন লেখকের রচনায়। ম্যান-মেড বা কৃত্রিমভাবে সৃষ্ট এই দুর্ভিক্ষে ‘ মারী আর মড়কের দুঃসহ আঘাতে বারবার বিপন্ন ‘ হয়ে যাওয়া কৃষিজীবী ও গ্রামের দরিদ্র মানুষ শহরমুখী হয়।
সুকান্তর অগ্রজ কবি সুভাষ মুখােপাধ্যায় লিখেছেন – ‘গ্রাম উঠে গিয়েছে শহরে’ (স্বাগত)।
কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য তাঁর সম্পাদিত ‘ আকাল’ (১৩৫১) কাব্যগ্রন্থের ‘কথামুখ’-এ লিখেছেন,

“তেরােশাে পঞ্চাশ সম্বন্ধে কোনাে বাঙালিকে কিছু বলতে যাওয়া অপচেষ্টা ছাড়া আর কী হতে পারে ? কেননা তেরশাে পঞ্চাশ কেবল ইতিহাসের একটা সাল নয়, নিজেই একটা স্বতন্ত্র ইতিহাস। সে ইতিহাস একটা দেশ শ্মশান হয়ে যাওয়ার ইতিহাস,ঘরভাঙা গ্রামছাড়ার ইতিহাস, দোরে দোরে কান্না আর পথে পথেমৃত্যুর ইতিহাস,আমাদের
অক্ষমতার ইতিহাস।”


— এই কথা ক’টিই প্রমাণ করে কিশাের কবিকে কীভাবে নাড়া দিয়েছিল এই মন্বন্তর বা আকাল ‘ এর প্রত্যেকটি কবিতাই ছিল কালবেলার বুভুক্ষু মানুষের যন্ত্রণার আর্তনাদ ও মস্থরের পরিণতি বিষয়ক কবিতা। সেই ভয়াবহ বাতাবরণে দাঁড়িয়ে কবি সুকান্ত নিজেকে তাই | ‘দুর্ভিক্ষের কবি’ বলে উল্লেখ করেছেন সঙ্গত কারণেই। দুর্ভিক্ষের বেদনা বিধুর কবিতাই কেবল তিনি রচনা করেন নি তুলে ধরেছেন খাদ্যের। সারিতে দাঁড়ানাে মানুষটির অসহায়তাকেও – “আমার বসন্ত কাটে খাদ্যের সারিতে প্রতীক্ষায়, / আমার বিনিদ্র রাতে সতর্ক সাইরেন ডেকে যায়।” (রবীন্দ্রনাথের প্রতি’/ ছাড়পত্র)
মন্বন্তরের মৃত্যু শবাকীর্ণ দিনগুলিতে একদিকে বিপন্ন সাধারণ মানুষ, অপরদিকে মুনাফালােভী কালােবাজারির ক্রমবর্ধমান শোষণের সঙ্গে তাল রেখে বাড়ছিল অসহায় হতাশ মানুষের আত্মসমর্পণ। ঘুরে দাঁড়ানাের স্বপ্ন নিয়েই কিশাের কবি প্রতিবাদে সােচ্চার হয়েছিলেন। তুলে নেন তার ধারালাে কলম; একের পর এক বিদ্রোহ, বিপ্লব আর প্রতিবাদের এলােপাথাড়ি আঁচড় দিতে থাকেন ঘুন-ধরা সমাজের গায়ে। ‘কলম’ও শেষ পর্যন্ত হয়ে ওঠে শোষিত মানুষ –


“কলম! বিদ্রোহ আজ দলবেঁধে ধর্মঘট করাে।
লেখক স্তম্ভিত হােক, কেরানিরা ছেড়ে দিক হাঁফ,
মহাজনী বন্ধ হােক, বন্ধ হােক মজুরের তাপ
উদ্বেগ আকুল হােক প্রিয়া যত দূর দেশে দেশে,
কলম ! বিদ্রোহ আজ, ধর্মঘট হােক অবশেষে;
আর কালাে কালি নয়, রক্তে আজ ইতিহাস লিখে
দেয়ালে দেয়ালে এঁটে হে কলম — আনাে দিকে দিকে।”
(কলম – ‘ছাড়পত্র)

আরও পড়ুনঃ👉 বাংলা কাব্যে বিষ্ণু দে-র অবদান

আধুনিক বাংলা কবিতায় কবি জীবনানন্দ দাশের অবদান


শোষক শ্রেণির প্রতি তীব্র ঘৃণা প্রতিফলিত হয়েছে তার ব্ল্যাক মার্কেট ছড়াটিতে –
“হাত করে মহাজন; হাত করে জোতদার,
ব্ল্যাকমার্কেট করে ধনীরাম পােদ্দার
গরীব চাষীকে মেরে হাতখানা পাকালাে
বালিগঞ্জেতে বাড়ি খান ছয় হাঁকলাে ।
কেউ নেই ত্রিভুবনে, নেই কিছু অভাব-ও
তবু ছাড়লাে না তার লােকমারা স্বভাব-ও।”
(ব্ল্যাকমার্কেট – ‘মিঠেকড়া’)

কাব্যরচনার গােড়াতেই সুকান্ত বুঝেছিলেন এই সময় কাব্যরচনা অলস বিনােদনের জন্য নয়। ক্ষুধার রাজ্য শুরু হয়ে গেছে। কাজেই রােমান্টিক ভাবালুতা আর চাঁদ-তারা-পাখি-গান-ফুল তাঁর কবিতা থেকে বিদায় নিয়েছে। রােমান্সের থালাভরা চাঁদ তার কাছে হয়ে ওঠে ঝলসানাে রুটি –

“হে মহাজীবন, আর এ কাব্য নয়/এবার কঠিন, কঠোর গদ্যে আনো,/পদ-লালিত্য ঝঙ্কার মুছে যাক / গদ্যের কড়া হাতুড়িকে আজ হানো!/ প্রয়োজন নেই কবিতার স্নিগ্ধতা—/কবিতা তোমায় দিলাম আজকে ছুটি,/ ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়:/ পূর্ণিমা-চাঁদ যেন ঝল্সানো রুটি।।(‘হে মহাজীবন’ /ছাড়পত্র)

আরও পড়ুনঃ👉বিহারীলাল চক্রবর্তীকে কে , কেন ‘গীতিকবিতার ভোরের পাখি ‘ বলেছেন?

বিশ্ব ইতিহাসে বেশ কিছু পরিবর্তন আরম্ভ হয়েছিল বিংশ শতকের দ্বিতীয় দশক থেকেই। ১৯১৭ খ্রীঃ রাশিয়ার সমাজতান্ত্রিক সােভিয়েত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা। ১৯১৯ এর রাওলাট আইনে যখন বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদী শক্তির নগ্নরূপ প্রকাশ পায়, তখন বাংলাদেশে জাতীয়তাবাদী এবং সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনের সমান্তরাল সাম্যবাদী ভাবধারা প্রবেশ করে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর পরিস্থিতিতে সমগ্র ইউরােপে যখন উত্তাল অবস্থা, ভারতের অবস্থাও তখন সংকটাপন্ন। ত্রিশের দশকে তখন শুরু হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের রণহুঙ্কার। জাপান আক্রমণ করল চিনকে, জার্মান আক্রমণ করল পােল্যান্ডকে
তখন মানবতার চরম অপমানে রবীন্দ্রনাথ ‘প্রায়শ্চিত্ত’, ‘বুদ্ধভক্তি’ প্রভৃতি কবিতায় প্রতিবাদ ব্যক্ত করেছিলেন। পৃথিবীব্যাপী শােষণের বিশেষ রূপই যে ভারতের ঔপনিবেশিক শাসন – সে সত্য অতি অল্প বয়সেই সুকান্তর কবি চেতনায় অপমানের জ্বালা রূপে প্রকাশ পেয়েছে –
“এ দেশে জন্মে পদাঘাত-ই শুধু পেলাম,
অবাক পৃথিবী সেলাম – তােমাকে সেলাম।” (অনুভব – ১৯৪০ ছাড়পত্র)

সেদিনের এই তরতাজা কিশােরের রক্তে ধ্বনিত হওয়া মার্কস, লেনিন, গাের্কি প্রমুখর সমাজতান্ত্রিক ও সাম্যবাদী ভাবনা অন্ততঃ যুগের প্রেরণার ফসল একথা ঠিক। সুকান্তও তাই সর্বহারার অবস্থানে দাঁড়িয়ে সাম্যবাদী ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন সে সময়। সমাজতান্ত্রিক সর্বহারার বিশ্বচেতনাই তাকে বাস্তববাদে উজ্জীবিত করেছে। সুকান্ত বিশ্বাস করতেন ব্যক্তিস্বাতন্ত্রকে ছাপিয়ে শােষিত মানুষের জয়লাভ-ই সর্বমানবের বাঁচার উপায়। আজকের কবিতা শ্রেণি সংগ্রামকেই উদ্বুদ্ধ করবে এটা স্বাভাবিক। কেননা শ্রেণি-শােষণে পঙ্গু সমাজের পরিবর্তন সাধিত হতে পারে একমাত্র তাদেরই সংগ্রামে। সুকান্তও তা-ই তাঁর কবিতাকে করে তুললেন সহজ সরল। সমালােচক অশােক ভট্টাচার্য সুকান্তকে তাই ‘সমাজতান্ত্রিক বাস্তববাদী’ কবি হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। (‘সুকান্ত প্রসঙ্গ’ – পৃষ্ঠা ৭৮)
সমালােচকের মতে, একজন সমাজতান্ত্রিক বাস্তববাদী কবির মতােই সুকান্তও জনগনের থেকে এক ধাপ এগিয়ে ছিলেন। জনগনকে তাই তিনি তাড়না না করে আহ্বান করেছেন –
“কতক্ষণ ভুলে থাকবে পেটের ক্ষুধা আর গলার। শিকলকে ? /কতক্ষণ নাড়তে থাকবে লেজ? /তার চেয়ে পােষমানাকে অস্বীকার করাে, অস্বীকার করাে বশ্যতাকে। চলাে শুকনাে হাড়ের বদলে।
সন্ধান করি তাজা রক্তের, তৈরি হােক লাল আগুনে ঝলসানাে আমাদের খাদ্য।”
(‘১লা মে-র কবিতা’ ৪৬ ‘/ ঘুমনেই)

শুধু তাই নয় আঠারাের এক যৌবনী শক্তি নিয়ে তিনি সকলকে আহ্বান জানান যাবতীয় বিরুদ্ধতা উপেক্ষা করে , ভয়ঙ্কর তুফান তুলে, রক্তের বদলে প্রতিষ্ঠা করতে এক শােষণমুক্ত সমাজ –
“বেজে উঠল কি সময়ের ঘড়ি ?
এসো তবে আজ বিদ্রোহ করি,
আমরা সবাই যে যার প্রহরী
উঠুক ডাক।
……..
দেখব, ওপরে আজো আছে কারা,
খসাব আঘাতে আকাশের তারা,
সারা দুনিয়াকে দেব শেষ নাড়া,
ছড়াব ধান।
জানি রক্তের পেছনে ডাকবে সুখের বান॥”
(‘বিদ্রোহের গান ‘/ ঘুম নেই)

সুকান্তর প্রত্যক্ষ তিক্ত অভিজ্ঞতা কখনাে তাঁর স্বপ্নকে ভেঙে দেয়নি। দীর্ঘায়ু জীবনের হতাশা ক্লান্তি তাকে জীর্ণ করে তােলেনি সত্য। তবে তাকে দেখা গেছে কখনাে কাতর, কখনাে দুর্জয়, কখনাে বিষন্ন হতে। রােমান্টিক প্রেমকল্পনা বয়সের ধর্মেই তারুন্যকে দোলাচল করে; কিন্তু সুকান্তর কাছে কঠোর বাস্তবের হাতছানিতে দেশও হয়ে উঠেছে প্রিয়তমা – “তােমাকে ফেলে এসেছি দারিদ্রের মধ্যে,/
ছুঁড়ে দিয়েছি দুর্ভিক্ষের আগুনে,/
…….. ……
তবু, একটি হৃদয় নেচে উঠবে আমার আবির্ভাবে
সে তােমার হৃদয়।” (‘প্রিয়তমাসু’ / ঘুম নেই)

‘পূর্বাভাস’, ‘ছাড়পত্র’, ‘ঘুমনেই’, মিঠেকড়া, ‘অভিযান’ ও ‘গীতিগুচ্ছের’ প্রতিটি কবিতাই প্রায় বাস্তবলব্ধ অভিজ্ঞতা, রাজনৈতিক চেতনা অথচ নিজস্বতায় সমৃদ্ধ গভীর মানবতাবােধের উপর প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। ‘সিগারেট’, ‘সিঁড়ি’, ‘দেশলাই কাঠি’, ‘কলম’ প্রভৃতি শােষিত নিপীড়িত মানুষের প্রতিনিধি হয়ে উঠেছে তাই তাঁর কবিতায়। পরিশেষে বলা যায়, সমকালিন দুর্ভিক্ষ,সমাজ রাজনীতি যেমন সুকান্তর কবিসত্তাকে নির্মাণ করেছে, তেমনি তাঁর মধ্যে তারুণ্য, মমত্ববােধ , সর্বোপরি এক কবিত্বশক্তিকে ভাষা দান করেছে – তা সহজেই উপলব্ধ। যুগকে অতিক্রম করার বাসনা সুকন্তর ছিল না , ছিল নতুন যুগের সন্ধান , যেখানে ঘটবে শোষণমুক্তি । আজকের রাজনৈতিক ভাবনায় উন্মত্ত আমজনতার কাছে , কিংবা সারাবিশ্বে কোভিডি-১৯ মহামারীর ভয়াবহতা দেখে আজকের কিশোর কবি সুকান্ত কী বার্তা উপস্থাপন করতেন খুব জানতে ইচ্ছে করে।তবে
আমার কাছে সুকন্তর এই কথাটি চির প্রাসঙ্গিক মনে হয় , যা আজো আমাদের অঙ্গীকারবদ্ধ হতে উদ্বুদ্ধ করতে পারে—
“যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ, প্রাণপণে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল।” (‘ছাড়পত্র’/ নাম কবিতা)

আরও পড়ুনঃ কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্তের অবদান

কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের অবদান

কবি মোহিতলাল মজুমদারের অবদান 

কবি যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত-র অবদান

বাংলা কাব্যে সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের অবদান

বাংলা কাব্যে কবি-মাইকেল মধুসূদন দত্তর অবদান

বাংলা কাব্যে কবি বুদ্ধদেব বসুর অবদান

লেখক- কিশোর মজুমদার
Blog : kishoremajumder.com

বাংলা ভাষা , সাহিত্য ও ব্যাকরণ বিষয়ক ওয়েবসাইটঃ shekhapora.com

তথ্যসূত্র:-
১। সুকান্ত প্রসঙ্গ (অশোক ভট্টাচার্য সম্পাদিত)
২। সুকান্ত সমগ্র
৩। আকাল( সুকান্ত ভট্টাচার্য সম্পাদিত)
৪। সুকান্তের জীবন ও কাব্য – ড. সরোজমোহন মিত্র
৫। উইকিপিডিয়া
৬। বিকাশপিডিয়া

×××××××××××

কিশোর মজুমদারের কবিতার তালিকা👇

*** কিশোর মজুমদারের “আমিও পারি” বইটি এখুনি অনলাইনে অর্ডার করতে পারেনঃ Link  

Patrabharati:  website:https://bit.ly/3fFw3Uu

Amazon : https://amzn.to/3sWoRad

Flipkart: https://bit.ly/3wyKyiL 

About the Author: Kishore Majumder

You might like

2 Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share