কবিতা : ফাঁকা পকেটে প্রেমের স্বপ্ন
কবি : কিশোর মজুমদার
ভিড়ের মাঝে হাজার চোখ
ও দুটো চোখ, খুঁজি না আমি আর
প্রাইভেট টিউশন , ঝিম ধরা মাথার ভিতর অগোছালো সিলেবাস
আজ যেন উত্তরহীন প্রশ্নের বসতবাড়ি
আর হতাশার বারান্দায়
একা দাঁড়িয়ে আমি … ভীষণ একা
সবকিছুই ধোঁয়াশা লাগে আজ।
মাকে বলেও কোনো লাভ হয় নি জানো
দীর্ঘশ্বাসের পাশে ভেজা আদর বাড়তি পাওনা ছিল শুধু
তুমি এলেই না আমার জীবনে
যন্ত্রণাগুলো চারাগাছের মত যত্নে লালন করা নস্টালজিক সুখে
চোখের জল আড়াল করতে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতাম অন্ধকারে ।
সেই থেকে অন্ধকার আমার প্রিয় –
কাঁদব না আমি আর ; পুরুষ মানুষ কাঁদতে নেই
ছোটবেলায় প্রথম সাইকেল চালাতে গিয়ে
পড়ে ব্যথা পেয়েছিলাম
সেদিন খুব কেঁদেছিলাম
কাকিমা আদর করে বুঝিয়েছিলেন, তুমি না বীরপুরুষ। পুরুষমানুষ কাঁদতে নেই ;
জীবনে কত্ত ব্যথা পাবে কত্ত সহ্য করতে হবে ;
তাই তো কাঁদি না আমি আর ।
ফাঁকা পকেটে কিছু স্বপ্ন পুষে রেখে
তোমাকেও জুড়ে নিলাম তাতে
আজ বুঝতে পারছি কত্ত বড় ভুল করেছিলাম
বিকেলের রোদে তোমার অবাধ্য ক’টা চুলের ফাঁকে
উঁকি দেওয়া আড় চোখের ভাষা
বুঝতে পারি নি আমি কোনোদিন
চোখের সামনে এখন কত্ত গ্রীষ্ম বর্ষা
মায়ের শূন্যদৃষ্টি , বাবার দিীর্ঘশ্বাস, রুগ্ন বোনের আশাহত চউনি
আর মরতে থাকা আমিটাকে ঝুল কালি জমতে থাকা অন্ধকার ঘরটায়
কতগুলো ইচ্ছে কুরে কুরে খায় …
খুব যন্ত্রণা হয়
নিজের সঙ্গে দেখা করতে ভয় করে আজ
(শুধু কটা কথা জানতে ইচ্ছে করে ;
খুব ইচ্ছে করে )
তুমি কেমন আছো ?
তোমার ডানপায়ের গোড়ালির ব্যথাটা এখনও আছে ?
বড্ড জানতে ইচ্ছে করে
মনে আছে তোমার
পেনসিল ভেবে তোমার আই লাইনারটা দিয়ে
সাদা পাতায় স্কেচ আঁকতে গেলাম ; হা হা হা
কত আনাড়ি ছিলাম বলো ।
আড়শোলা দেখে তোমার কী ভয় কী ভয়
ভয় পাও এখনো ?
সুখে আছো বুঝি
ভালো থাকবে
সুখীগৃহকোণটুকু সাজিয়ে নিও নিজের মতো করে
তবে কোনোদিন যেন সাইড টেবিলে গোল কাঁচের জারে
গোল্ড ফিস রেখো না
ওটা না হয় আমাদের মৃত স্বপ্নের জীবাশ্ম হয়েই থাক
বন্ধ চোখের দেয়ালে।
আমার হাত ঘড়িটা বন্ধ হয়ে গেছে
জীবনের সুখের সময় তো ; বেশিদিন চলে নি
তুলে রেখে দিয়েছি
তোমার ছোঁয়াগুলো যেখানে রোজ জমছে
ধুলো ঝাড়তে গিয়ে বড্ড শ্বাসকষ্ট …
একটু চোখের জলে ভিজিয়ে নিতে হয়
কিন্তু বিশ্বাস করো
কাঁদিনা আমি আর
বাবার পঙ্গু শরীরের যন্ত্রণা আর চীৎকারগুলোই
ভুলিয়ে দিয়েছে আমার কান্নার ভাষা
মায়ের ক্লান্ত হাতের রুটি
আর বিষণ্ণ চোখের বেদনা
বিশ্বাস করো , লুকিয়ে রাখতে বাধ্য করেছে বেকারের নিভে নিভে জ্বলতে থাকা
কষ্টের পাহাড়টাকে
টিউশনির কটা টাকা
পকেটের স্বপ্নকে-প্রেমকে ফাঁকা করে জমতে থাকে বাজারের ব্যাগে ;
ঝরা পাতার মতো বিষণ্ণ সময়ে
ছোটো বোনের বিয়ের বয়স
ফালা ফালা সবজির মতো করে কাটছে সংসারের বঁটিতে
ভালই করেছো তুমি
রোম্যান্টিক গল্প আর ভালোবাসার ফুলঝুরি
পেটের খিদের কাছে তো হার মানবেই;
ভিড়ের মাঝে একঝলক দেখলাম শুধু
মুটিয়ে গেছ একটুখানি
ঠোঁটের লিপস্টিকের রংটা আজো সেই কমলা রঙের
বেশ গিন্নিবাণ্ণী ভাব হয়েছে তোমার
পরস্ত্রী
তাই বেশি দেখিনি আর , বিশ্বাস করো ।
থুঁতনির নীচে তিলটায় এখন অন্য কেঊ আঙুল বূলায়
বুলায় আঙুল ?
চাকরির জন্য অপেক্ষা—চেষ্টা –অপেক্ষা
দাদা-কাকা-মামাদের আশ্বাসের দীর্ঘ রেলপথেই
এসে গেল তোমার স্টেশন
অন্য কারো সহযাত্রী হতে …
তুমি চলেই গেলে
একা হয়ে গেলাম আমি
সত্যিই তো জীবনের কত সুখ কত স্বপ্ন কত কত সাজানোর থাকে
ছবির মত জীবন আর সমাজ সংসার আত্মীয় পরিজন
সবকিছুই অক্ষত অটুট রাখতেই হল তোমায়
দুটো ঘরকে ফিরিয়ে দিয়ে মণে আছে তুমি বলেছিলে
ভালোবাসার ঘরই আমরা তৈরি করবো
যে ঘর এ চারটি খুঁটি থাকলেই হবে স্বর্গের মতো
প্রেম বিশ্বাস ভরসা আর
আর আদর …।
তৃতীয় বার আর ফেরাতে পারলে না ;
চেষ্টায় চেষ্টায় ঘড়ির কাঁটাগুলোই শুধু কয়েক লক্ষবার প্রদক্ষিণ করে গেল ।
বিদায় দিতে এসে চোখের জলের সংগে
হাত ঘড়িটাও তুমি দিয়েছিলে সেদিনই
রোজ লেট করে আসতাম বলে
কত গাল ফুলানো অভিমান
আজ আর ঘড়িটাও ঘোরে না
সময়গুলোও চলে গেছে তোমার সঙ্গে কাঁচঘরের ভেতরে
একটা অনিশ্চিত জীবনের থেকে সাজানো জীবনের সুখী গৃহকোণের
নিশ্চিন্ত আয়েশটুকু বড় লোভনীয় ছিল
তাই না বল ?
একটা বেকার, –বেকার ছেলের জীবনে স্বপ্নের ইমারত গড়ে
সেই স্বপ্নের দেয়ালে লাথি মেরে নিজের সুখের মধুচন্দ্রিমার ফুল সাজাতে
লজ্জা করে না স্বার্থপরের মত ?
তিলে তিলে গড়ে ওঠা কাঁচের পৃথিবীটা ভেঙ্গে চুরমার করে
আমাকে একা করে দিয়ে
টুকরো টুকরো কাঁচের যন্ত্রনায় বিদ্ধ করে তিলে তিলে মেরে
কী সুখ পাচ্ছ তুমি বল ?
আমাদের ছোটো সংসারের দুঃখ কষ্টে
একটা বেকার ছেলের জীবনে
জোর করে তোমাকে কীভাবে টেনে আনতে পারি বলো ?
এবার ভাবছি ঘুরে দাঁড়াব ; ঘুরে দাঁড়াব ? কিন্তু শক্তি পাচ্ছি কই !
খুব ভালো থেকো তুমি …
আর , আর আকাশের ঠিকানায় কোন চিঠি লিখো না ।
কক্ষনো না ।