মোক্তার চাচা
কিশোর মজুমদার
— মাইনো কোটে যাবু ?
বলেই মোক্তার চাচা ঘাড়ের গামছা দিয়ে রিক্সার সিটটা দু’বার ঝেড়ে দেন।
তিনি নাকি পঞ্চাশ বছর ধ’রে এই শহরে রিক্সা চালিয়ে আসছেন ।
তখন শহরটা ছিল সুনসান , ডাক্তার বলতে ওই নিধু ডাক্তার- সর্ব রোগের সহায়;
এখন আর নেই।
ওইখানে নাকি একটা বটগাছ ছিল,
তাঁর তলায় বসতো মাছের বাজার, একটা সেলুন,
পাশেই রিক্সা স্ট্যান্ডে দাঁড়াত দুটো মাত্র রিক্সা
একটা গজেন বড়াই, আরেকটা এই মোক্তার চাচা ।
তারপর যুক্তফ্রন্ট পেরিয়ে , কত দিনের কত গল্প ধুয়ে মুছে গড়ে উঠলো উন্নয়ন দপ্তরের বিশাল বাড়িটা ।
দেখা যায় ঝাঁ চকচকে ইমারতের সামনে দেশি বিদেশি ফুলের বাগান। মাঝখানে মাইক্রো জেরক্সের মতো
বনসাই বটগাছটিকে সদ্য পটিং করা হয়েছে
সিরামিক ট্রে-তে ।
আড়ালের অতীত গল্পগুলো রিক্সায় যেতে যেতে
মোক্তার চাচার মুখে দীর্ঘশ্বাসের মতো লাগে।
— মাইনো, তোর বাপোক মুই ন্যাংটা দেইকচোং । তারে বেটি তুই এলা বড়ো হয়্যা গেচিস। কলেজোত পড়িস।
— কলেজে পড়ি না চাচা । আমি এখন চাকরি করি– কলেজ পাস করে গেছি।
— বাঁচি থাক মাও ।
মোক্তার চাচা দাদুর বয়সী । বাবা, কাকা, দাদা– সবারই প্রিয় মোক্তার চাচা। ঝড়-বৃষ্টি-বাদলের বন্ধু মোক্তার চাচা।
এই শহরের কোণে রাজ আমলের পোড়ো বাড়িটার মতোই শহরের ঝুরঝুরে ইতিহাস — মোক্তার চাচা ।
একা একটা রিক্সা নিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে যাত্রীর অপেক্ষায় ।
রিক্সার সিটে বসে বসে বিড়ি টানে ,
কাগজে মোড়ানো রুটি খায় –আর তাকিয়ে থাকে দ্রুতবেগে ছুটে চলা যাত্রী বোঝাই সিটি অটো , টোটো রিক্সাগুলোর দিকে।
পরিচিত কয়েকটা বাড়ির চালের বস্তা আনা , আর নেহাত ঠেকে যাওয়া কয়েকটা ভাড়া ছাড়া
মোক্তার চাচার বিশেষ আয় নেই।
তবু,শহরের কত পুরোনো গল্প কথা নিয়ে
আব্দুল মাঝির মতো থুতনির দাড়িতে হাত বুলায় চাচা ,
পাশেই উন্নয়নের পিচগলা রাস্তায় দ্রুত গতিতে ছুটে চলে জীবন।
আজও মোক্তার চাচা ঠায় দাঁড়িয়ে যাত্রীর অপেক্ষায়।
গল্পটা শেষ হয়নি এখনো ।
চৌত্রিশ দিন পর বাড়িতে যাচ্ছি । মায়ের হাঁটুর ব্যাথা শুনেই রওনা দিলাম।
মোড়ের কাছে আসতেই মেয়ে চেচিয়ে বলছে —
— মম , দিস ইস রিকশোও । ইজ ইন্ট ? মম রিক্সে চড়বো। প্লি–জ
ড্রাইভারকে বললাম গাড়ি থামাতে । নেমে পড়লাম মেয়ের হাত ধ’রে।
রিক্সা নিয়ে মোক্তার চাচা । কাছে দাঁড়াতেই বিস্ময় ভরা দু’চোখ গামছায় মুছে
তাড়াতাড়ি রিক্সা থেকে নেমে দাঁড়ালো ,
— কেমন আছো মোক্তার চাচা ?
— ভালে আছোং মাও । তোর বেটি ?
বলেই উত্তরের অপেক্ষা না করে আমার মেয়ে তোর্ষাকে দেখতে লাগলো চাচা ।
— হ্যাঁ চাচা । আমার মেয়ে। ও রিক্সা চড়বে বলে বায়না ধরেছে।
ঘাড়ের গামছা দিয়ে সিটটা মুছে দিতেই মেয়েকে তুলে দিয়ে
উঠে বসলাম আমার আজন্ম পরিচিত রিক্সায় ।
— মাইনো কোটে যাবু ? সেই একই পরিচিত জিজ্ঞাসা।
— চাচা দিঘিটা এক চক্কর দিয়ে আসি , নিয়ে চলো। আমার মেয়ে তো রিক্সা চড়েনি আজ ফাস্ট চড়বে । তাই আজ ওর খুব আনন্দের দিন।
তারপর তোর্ষাকে বললাম , আমার অন্নপ্রাশনেও চাচার রিক্সা চড়েই মদনবাড়িতে গিয়েছিলাম । তারপর স্কুল , কলেজ , ডাক্তার দেখানো, দুর্গাপুজোয় বেড়ানো– এই মোক্তার চাচার রিক্সা চড়েই বড় হয়েছি।
রিক্সা থেকে নেমে একটা পঞ্চাশ টাকার নোট বের করে চাচাকে দিতে যাচ্ছি —
— মাইনো, তোর বেটি পোত্থম মোর রিস্কাত চড়িল । মুই ধইন্নো হয়্যা গেলুং। পাইসা নিম না ,মাও ।
— চাচা তোমার পয়াসা না নিলে চলবে কী করে ?
— মাওরে, সারা জীবন তোমাট্টে ম্যালা কামাই কইচ্চোং । আইজকা তোর বেটির বাদে পাইসা নিবার না কইস।
তোর্ষা দৌড়ে বাড়ির ভেতরে চলে যায়।
হাতে রইল পঞ্চাশ টাকা । টাকার উপরেও যে জিনিসটা আছে , সেটার খোঁজ দিয়ে গর্বিত মোক্তার চাচা
উন্নয়নের পিচ-কালো রাস্তা ধরে দূরে ভিড়ের ঝাপসায় মিশে যায়।
এখনো যতবার পঞ্চাশ টাকার নোট হাতে আসে —
মোক্তার চাচার কথা মনে পড়ে।
হাতের পঞ্চাশ টাকার নোট আজও তাঁকে দেওয়া হল না ।
সেই আমার শেষ দেখা মোক্তার চাচাকে ।
তারপর কতবার গেছি মায়ের কাছে , মোক্তার চাচাকে আর দেখতে পাই নি ।
যেখানে রিক্সা নিয়ে দাঁড়াতেন চাচা —
সেখানে আজ মনীষীর মূর্তি — তলাটা শান বাঁধানো,
যার নীচে চাপা পড়ে আছে
আমাদের মোক্তার চাচার অশ্রু – ঘাম – শহরের জীবন্ত দীর্ঘশ্বাস।
রিক্সা দেখলে আজও সেই মুখটা খুঁজি , রিক্সার শব্দে কান পাতি, যদি শুনতে পাই–
— মাইনো কোটে যাবু ?
—কোটে যাবু মাইনো ?
Xxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxxx
আমিও পারি কবিতার বইটি এখন অনলাইনে পাওয়া যাচ্ছে।
{Tags: আবৃত্তির কবিতা, কিশোর মজুমদারের কবিতা, আবৃত্তির সেরা কবিতা, বাংলা কবিতা, আধুনিক কবিতা, bengali poetry for recitation, bangla kobita abritti, amio pari kobita, bengali duet poems, bangla kobita lyrics, premer kobita, বাংলা কবিতা রোমান্টিক, somaj niye kobita, desattobodhok kobita, দেশাত্মবোধক কবিতা, মোক্তার চাচা,moktar chacha kobita,} premer kobita, abritir kobita bangla,